নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নিন

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসাঃ জীবন বৃত্তের প্রথম অধ্যায় হলো জন্ম। জন্মের পর প্রত্যেক শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যত্নশীল পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যা অপরিহার্য। নবজাতকের জন্ডিস একটি খুব কমন সমস্যা, যা অবহেলা করলে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। তাই নবজাতকের জন্ডিসের লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসঃ লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা

আর তাই আপনাদের সুবিধার্থে এই আর্টিকেলটিতে নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা সহ সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। সুতরাং আপনি যদি এই বিষয় গুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে চান, তাহলে আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুণ।

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের লক্ষণ

নবজাতক শিশুদের জন্ডিস হলো খুব কমন একটা সমস্যা, যাতে শিশুর ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যায়। এটি একটি হলুদ পদার্থ বিলিরুবিনের কারণে হয় যা লাল রক্ত ​​কোষের ভাঙ্গনের ফলে উৎপন্ন হয়। লিভার বিলিরুবিনকে শরীর থেকে অপসারণ করতে সাহায্য করে। ফলে নবজাতকদের লিভার পুরোপুরি পরিপক্ক না হওয়ায় তাদের শরীরে বিলিরুবিন জমে জন্ডিস হতে পারে।

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের প্রধান লক্ষণ হলো শিশুর ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া। প্রথমে মুখ হলুদ হয়ে যায়, তারপর বুক ও পেট এবং শেষে পা। শিশুর চোখের সাদা অংশও হলুদ হয়ে যায়। নিচে নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের লক্ষণ গুলো তুলে ধরা হলো।

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের অন্যান্য লক্ষণগুলি হলঃ

  • শিশুর ঘুম অনেক বেশি হওয়া
  • শিশুর জ্বরের মতো ভাব হওয়া
  • শিশুর ঝিমোজাভাব বা অলসতা হওয়া 
  • শিশুর খাওয়া কমে যাওয়া
  • শিশুর কান্নার সময় চোখের সাদা অংশে হলুদ রঙ দেখা যেতে পারে।

নবজাতক শিশুর জন্ডিসের বেশির ভাগ লক্ষণগুলি সাধারণত জন্মের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখা যায় এবং ২ সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্ডিস ২ সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হতে পারে। যদি আপনার সন্তানের জন্ডিসের লক্ষণ গুলো দেখা দেয়, তাহলে খুব তাড়াতারি একজন বিষেশজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। 

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের লক্ষণগুলি নির্ণয়ের জন্য বিষেশজ্ঞ ডাক্তার শিশুর রক্ত পরীক্ষা করবেন। রক্ত পরীক্ষায় শিশুর রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করবেন। বিলিরুবিন হলো একটি হলুদ পদার্থ যা লাল রক্ত ​​কোষের ভাঙ্গনের কারণে আসে। জন্ডিসের ক্ষেত্রে শিশুর রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেশি থাকে। শিশুর জন্ডিসের মাত্রা নির্ধারণ করে ডাক্তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবেন। 

মনে রাখবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, নবজাতক শিশুর জন্ডিসের চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে, কিছু ক্ষেত্রে শিশুকে ফটোথেরাপি বা রক্ত পরিবর্তন করা প্রয়োজন হতে পারে। "ফটোথেরাপি" হলো একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে শিশুকে একটি বিশেষ আলোর নীচে রাখা হয়। আলোর প্রভাবে বিলিরুবিন ভেঙে প্রস্রাব ও মলের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। রক্ত পরিবর্তন হলো একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে শিশুর রক্তে বিলিরুবিনযুক্ত অংশ ফেলে দিয়ে নতুন রক্ত দেওয়া হয়।

নবজাতকের জন্ডিস কেন হয়

নবজাতকের জন্ডিসের প্রধান কারণ হলো শিশুর রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। বিলিরুবিন হলো একটি হলুদ পদার্থ যা লাল রক্ত ​​কোষের ভাঙ্গনের কারণে আসে। সাধারণত, লিভার এই বিলিরুবিনকে ভেঙে প্রস্রাব ও মলের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। তবে, কিছু কারণে শিশুর লিভার বিলিরুবিনকে সঠিকভাবে ভেঙে ফেলতে পারে না, ফলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়।

নবজাতকের জন্ডিসের প্রধান কারণগুলি হলঃ

  • ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসঃ এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরণের জন্ডিস। এটি সাধারণত জন্মের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখা যায় এবং ২ সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। এই ধরনের জন্ডিসের কারণ হলো শিশুর লিভার এখনও সম্পূর্ণভাবে পরিপক্ক হয়নি।

  • মাতৃ-শিশুর রক্তের গ্রুপের অসঙ্গতিঃ এটি একটি গুরুতর ধরনের জন্ডিস। এটি তখন ঘটে যখন মায়ের রক্তের গ্রুপ বা Rh ফ্যাক্টর শিশুর সাথে একই নয়। এই ধরনের জন্ডিসের ক্ষেত্রে, শিশুর রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় যা শিশুর লাল রক্ত ​​কোষকে ধ্বংস করে।

  • গর্ভাবস্থায় সংক্রমণঃ গর্ভাবস্থায় মায়ের সংক্রমণ যেমন টক্সোপ্লাজমোসিস, সিফিলিস বা হিমোলাইটিক রক্তের ব্যাধি শিশুর জন্ডিসের কারণ হতে পারে।

  • জন্মগত জন্ডিসঃ জন্মগত জন্ডিসের কারণ হলো শিশুর লিভারে জন্মগত ত্রুটি। এই ধরনের জন্ডিস সাধারণত জন্মের পরপরই দেখা দেয় এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

নবজাতকের জন্ডিসের অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছেঃ

  • অকাল জন্ম
  • কম ওজনে জন্ম
  • নবজাতকের রক্তে সংক্রমণ
  • নবজাতকের যকৃতের রোগ

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসা

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসা শিশুর বয়স এবং জন্ডিসের সঠিক কারণের উপর নির্ভর করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, জন্ডিস নিজে থেকেই চলে যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে কিছু শিশুর প্রয়োজন হয় জন্ডিস চিকিৎসা

চিকিৎসার লক্ষ্য

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসার লক্ষ্য হল শিশুর রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা কমানো। বিলিরুবিন হল একটি হলুদ পদার্থ যা লাল রক্ত ​​কোষের ভাঙ্গনের কারণে আসে। লিভার শরীর থেকে বিলিরুবিন অপসারণ করতে সাহায্য করে।

ফটোথেরাপি

ফটোথেরাপি হল নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসার সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে, শিশুকে একটি বিশেষ আলোর নিচে রাখা হয়। আলো বিলিরুবিনকে ভাঙতে সাহায্য করে যাতে তা শরীর থেকে সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে।

ফটোথেরাপি সাধারণত নবজাতকদের জন্ডিসের জন্য প্রথম-লাইন চিকিৎসা। এটি সাধারণত হাসপাতালে করা হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে বাড়িতেও করা যেতে পারে।

রক্ত পরিবর্তন

রক্ত পরিবর্তন হল নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের আরেকটি চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে, শিশুর রক্তে বিলিরুবিনযুক্ত রক্ত বের করে দেওয়া হয় এবং তা পরিবর্তে বিলিরুবিন-মুক্ত রক্ত দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।

রক্ত পরিবর্তন সাধারণত খুব গুরুতর জন্ডিসের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়।

অন্যান্য চিকিৎসা

অন্যান্য কিছু চিকিৎসাও নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন:

  • ফিব্রিনোজেন-ডেফিসিয়েন্সি জন্ডিসের ক্ষেত্রে, শিশুকে ফিব্রিনোজেন ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।
  • হেমালিটিক জন্ডিসের ক্ষেত্রে, শিশুকে রক্তের গ্রুপের অনুপযুক্ততার জন্য চিকিত্সা দেওয়া যেতে পারে।
  • অন্যান্য জটিল জন্ডিসের ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট ওষুধ বা চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসার ঝুঁকি

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসার বেশ কয়েকটি ঝুঁকি রয়েছে। যেমনঃ

  • ফটোথেরাপির ক্ষেত্রে, শিশুর ত্বক জ্বলতে পারে।
  • রক্ত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, শিশুর রক্তের সাথে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
  • অন্যান্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট ওষুধ বা চিকিৎসার ঝুঁকি থাকে।

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসার পরবর্তী যত্ন

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসার পর, শিশুর রক্তের বিলিরুবিনের মাত্রা পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করা উচিত। যদি বিলিরুবিনের মাত্রা আবার বাড়তে শুরু করে, তাহলে শিশুর পুনরায় চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।

নবজাতক শিশুদের জন্ডিসের চিকিৎসার সময়, শিশুর যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনে রাখা উচিত।

  • শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ বা ফর্মুলা খাওয়াতে হবে।
  • শিশুকে হাইড্রেটেড রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে তরল খাওয়াতে হবে।
  • শিশুকে সরাসরি সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করতে হবে।

নবজাতক শিশুদের জন্ডিস প্রতিরোধ

নবজাতক শিশুদের জন্ডিস প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারেঃ

  • গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবকালে সঠিক যত্ন নেওয়া।
  • জন্মের পরপরই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা।
  • নবজাতকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো।
Previou Movie Next Movie