নবজাতক শিশুর হাম হলে করণীয় জেনে নিন
আপনার নবজাতক শিশুর কি হাম হয়েছে? কি করবেন বুজতে পারতেছেন না? নবজাতক শিশুর হাম হলে করণীয় কি আপনি যদি জানতে চান, তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য। এই আর্টিকেলটিতে শিশুদের হাম কেন হয়, শিশুর হামের লক্ষণ, শিশুর হাম হলে পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে, নবজাতক শিশুর হাম হলে করণীয় এবং শিশুদের হাম হলে কি খেতে হবে ইত্যাদি সহ সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তাহলে চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
শিশুদের হাম কেন হয়
হাম সাধারণত একটি ভাইরাস জনিত রোগ। শিশুদের হাম হয় সাধারণত রেড ভ্যারিসেলেলা-জস্টার ভাইরাস (RSV) নামক ভাইরাসের কারণে। এই ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং হামে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে অন্যদের শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির নাক বা গলার নিঃসরণের সংস্পর্শে আসলেও এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। বিশেষ করে শিশুরা হামে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
শিশুরা হামে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকে কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনও সম্পূর্ণরূপে গঠিত হয় না ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম থাকে। এছাড়া যারা টিকা নেয়নি তারাও হামে আক্রান্ত হওয়ার অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
হাম সাধারণত ৯ মাস থেকে ১২ মাস বয়সের শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তবে যেকোনো বয়সের শিশুরা হামে আক্রান্ত হতে পারে। আশা করি, শিশুদের হাম কেন হয় বুঝতে পেরেছেন।
শিশুর হামের লক্ষণ
আপনাদের সুবিদার জন্য নিচে শিশুর হামের লক্ষণ গুলো তুলে ধরা হলো। শিশুর হামের লক্ষণ গুলো সাধারণত সংক্রমণের ৮ থেকে ১২ দিন পর দেখা দেয়। লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
জ্বরঃ নবজাতক শিশুর হামের প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ হল জ্বর। জামে আক্রান্ত নবজাতক শিশুর জ্বর সাধারণত ১০৩ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৯ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত হতে পারে।
সর্দিঃ হামে আক্রান্ত শিশুদের আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে সর্দি। হামে আক্রান্ত শিশুর সর্দি লাগতে পারে। সর্দিতে নাক দিয়ে পানি পড়তে পারে, হাঁচি হতে পারে এবং গলা ব্যথা হতে পারে।
কাশিঃ হামে আক্রান্ত নবজাতক শিশুর কাশি হতে পারে। কাশি সাধারণত শুষ্ক এবং কাশি দেওয়ার সময় বুকে ব্যথা অনুভব হতে পারে।
চোখ লাল হয়ে যাওয়াঃ হামে আক্রান্ত শিশুদের সাধারণত চোখ লাল হয়ে যেতে পারে। চোখ লাল হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি চোখ থেকে পানি পড়তে পারে।
মুখে ছোট ছোট ফোস্কা পড়াঃ হামে আক্রান্ত নবজাতক শিশুদের মুখে ছোট ছোট ফোস্কা দেখা দিতে পারে। এই ফোস্কাগুলো সাধারণত লালচে রঙের হয় এবং কিছুদিন পর শুকিয়ে যায়।
শরীরে লালচে দাগঃ হামের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ হল শরীরে লালচে দাগ দেখা দেয়া। লালচে দাগ সাধারণত মুখ থেকে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই লালচে দাগ সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয়।
মনে রাখবেন, হামের লক্ষণগুলো সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে এটি গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যেমনঃ
- নিউমোনিয়া
- ব্রঙ্কাইটিস
- এনসেফালাইটিস (মস্তিষ্কের প্রদাহ)
- সেপসিস (রক্তের সংক্রমণ)
- অন্ধত্ব
আরো মনে রাখবেন, হাম একটি গুরুতর রোগ। তাই শিশুদের হাম থেকে রক্ষা করার জন্য সঠিক সময়ে টিকা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমণকি উপরে উল্লেখিত লক্ষণ গুলো আপনার শিশুর শরীরে দেখা দিলে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
শিশুর হাম হলে পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে
আমরা সকলেই জানি, হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি একটি ছোয়াছে রোগ। এটি সাধারণত জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের জল পড়া, ফোলা টনসিল এবং গালের ভিতরে ছোট ছোট ফোড়ার সহ বেশ কিছু লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত। হাম সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি আকারের হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে, এমনকি কিছু কিছু এটি বসন্তের চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, যেমন:
নিউমোনিয়াঃ হামের কারণে অনেক সময় শিশুদের নিউমোনিয়া হতে পারে, যা ফুসফুসের সংক্রমণ। যা আস্তে আস্তে ভয়াবহ হতে পারে।
ব্রেন হেমোরেজিঃ হামের কারণে অনেক নবজাতক শিশুর সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হতে পারে তা হল মস্তিষ্কে রক্তপাত হতে পারে, যা গুরুতর অক্ষমতা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
মেনিনজাইটিসঃ হামের কারণে নবজাতক শিশুর মেনিনজাইটিস হতে পারে, যা মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নার আবরণের সংক্রমণ। এটিও ভায়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
হেপাটাইটিসঃ হামে আক্রান্ত শিশুর শরীরে হেপাটাইটিস হতে পারে, যা লিভারের সংক্রমণ।
অন্ধত্বঃ হামে আক্রান্ত নবজাতক শিশু অনেক ক্ষেত্রে অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
হামের কারণে মৃত্যুহার সাধারণত ১% থেকে ২% হয়, তবে শিশুদের মধ্যে এটি ১০% পর্যন্ত হতে পারে।
হামের পরিণামগুলি ব্যক্তির বয়স, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য অবস্থার উপর নির্ভর করে। সাধারণত, শিশু এবং বয়স্করা হামে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
মনে রাখবেন, হাম একটি খুবই গুরুতর রোগ। কোন ভাবেই এটিকে হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয়।
নবজাতক শিশুর হাম হলে করণীয়
আপনাদের সুবিদার জন্য নিচে নবজাতক শিশুর হাম হলে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। এটা সকলেরই মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, হামের টিকা সাধারণত দুটি ডোজে দেওয়া হয়। প্রথম ডোজ ১২ থেকে ১৫ মাস বয়সে এবং দ্বিতীয় ডোজ ৪ থেকে ৬ বছর বয়সে। তাই, নবজাতক শিশুদের জন্মের প্রথম কয়েক মাসে হামের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া হয় না।
যদি আপনার নবজাতক শিশুর হাম হওয়ার বিষয়ে আপনার কোনরকম সন্দেহ হয় বা উপরে উল্লেখিত লক্ষণ গুলো আপনার নবজাতক শিশুর মধ্যে দেখতে পান, তাহলে অবিলম্বে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাম শিশুদের জন্য গুরুতর হতে পারে এবং দ্রুত জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
যেহেতু নবজাতক শিশুরা হামের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে না, তাই তারা এই রোগে আক্রান্ত হলে গুরুতর হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
নবজাতক শিশুর হাম হলে করণীয় নিম্নরূপঃ
- শিশুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। শিশু বিশেষজ্ঞ শিশুর অবস্থা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন যে শিশুর আসলেই হাম হয়েছে কিনা। ডাক্তারের দেওয়া পরামর্শ অনুসরণ করুন। হামের জন্য কোনও নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই, তবে সহায়ক যত্ন, যেমন পর্যাপ্ত হাইড্রেশন নিশ্চিত করা এবং জটিলতাগুলি মোকাবেলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- শিশুকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখুন। যেহেতু, হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক রোগ, তাই শিশুকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা খুবই জরুরি। এতে করে অন্যরা হাম আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে হাম সংক্রামিত হবে না।
- শিশুকে প্রচুর পরিমাণে তরল পান করানো উচিত। হাম হলে শিশুরা পানিশূন্যতার ঝুঁকিতে থাকে, তাই তাদের প্রচুর পরিমাণে তরল পান করানো খুবই জরুরি।
- জ্বর হলে শিশুকে প্যারাসিটামল দিন। আমরা সকলেই জানি, প্যারাসিটামল জ্বর কমাতে সাহায্য করে।
- শিশুর মুখে এবং নাকে ময়লা জমে যাওয়া রোধ করুন
এবং তা খুব তাড়াতারি পরিস্কার করুন। শিশুর মুখে
এবং নাকে ময়লা জমে গেলে তা থেকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে।
- শিশুকে সবসময় আরামদায়ক পরিবেশে রাখুন। শিশুকে আরামদায়ক পরিবেশে রাখলে তার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
নবজাতক শিশুর হামের চিকিৎসায় সাধারণত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া হয় না। কারণ, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের কার্যকারিতা নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়নি।
মনে রাখবেন, নবজাতক শিশুদের হাম প্রতিরোধের জন্য তাদের হামের টিকা দেওয়া খুবই জরুরি। হামের টিকা সাধারণত শিশুদের ৯ থেকে ১২ মাস বয়সে দেওয়া হয়।
শিশুদের হাম হলে কি খেতে হবে
শিশুদের হাম হলে তাদের প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো জরুরি। হাম হলে শিশুরা সাধারণত জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের জল পড়া, ফোলা টনসিল এবং গালের ভিতরে ছোট ছোট ফুসকুড়ি দ্বারা আক্রান্ত হয়।
এই লক্ষণগুলির কারণে শিশুরা খাবার খেতে অনিচ্ছুক হতে পারে এবং মুখের রুচি কমে যেতে পারে। তবে, শিশুটি যদি ঠিক মত খাবার না খায় তাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই শিশুদের হাম থেকে দ্রুত সুস্থ হতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো অনেক জরুরি।
শিশুদের হাম হলে কি খেতে হবে সেগুলি হলঃ
- তরল খাবারঃ হাম হলে শিশুরা অনেক বেশি পানিশূন্যতার ঝুঁকিতে থাকে। তাই তাদের প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়ানো উচিত। তরল খাবারের মধ্যে রয়েছেঃ
- পানি
- ডাবের পানি
- ফলের রস
- ঝোল
- স্যুপ ইত্যাদি
- নরম খাবারঃ হাম হলে শিশুদের গলা ব্যথা হতে পারে ফলে তার সব খাবার গিলতে পারবে না। তাই তাদের নরম খাবার খাওয়ানো উচিত। নরম খাবারের মধ্যে রয়েছে:
- মাখন
- পনির
- দই
- পুডিং
- সুজি
- ভাত ইত্যাদি
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারঃ হাম হলে শিশুদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশে কমে যায়। তাই তাদের প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে,যেমনঃ
- মাছ
- মাংস
- ডিম
- দুধ
- ডাল ইত্যাদি
শিশুদের হাম হলে নিম্নলিখিত খাবারগুলি খাওয়ানো উচিত নয়ঃ
- খোসাযুক্ত ফলঃ যেহেতু হাম হলে শিশুদের গলা ব্যথা হয়ে যায়। তাই খোসাযুক্ত ফল খাওয়ালে শিশুদের গলায় আটকে যেতে পারে।
- কাঁচা খাবারঃ কাঁচা খাবার খেলে নবজাতক শিশুদের পেটে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে।
- মসলাযুক্ত খাবারঃ মসলাযুক্ত খাবার খেলে নবজাতক শিশুদের গলায় জ্বালা হতে পারে।
মনে রাখতে হবে, শিশুদের হাম হলে তাদের খাবার পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর রাখতে হবে। খাবার খাওয়ার আগে এবং পরে শিশুদের হাত ভালো করে ধুয়ে দিতে হবে।
সাধারণ কিছু প্রশ্ন ও উওর বা FAQ
নবজাতক শিশুদের হাম হলে কি মারা যাওয়ার সম্বাবনা থাকে?
হ্যা। নবজাতক শিশুদের হাম হলে শতকরা ১০% পর্যন্ত শিশু মারা যাওয়ার সম্বাবনা থাকে।
নবজাতক শিশুদের কোন বয়সে হামের টিকা দেয়া হয়?
নবজাতক শিশুদের সাধারণত ৯ থেকে ১২ মাস বয়সে প্রথম টিকা এবং ৪ থেকে ৬ বছর বয়সে দুই নাম্বার টিকা দেওয়া হয়ে থাকে।
নবজাতক শিশুর হাম কি প্রতিরোধ করা যায়?
হ্যাঁ, নবজাতক শিশুর হাম প্রতিরোধ করা যায়। নবজাতক শিশুকে হামের টিকা দেওয়া হলে তারা হাম থেকে সুরক্ষিত থাকে।
নবজাতক শিশুর হামের লক্ষণ কী কী?
নবজাতক শিশুর হামের লক্ষণগুলি সাধারণত
হাম আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ১০ থেকে ১২ দিন পরে দেখা দেয়। লক্ষণগুলির
মধ্যে রয়েছেঃ
- জ্বর
- সর্দি
- কাশি
- গলা ব্যথা
- মাথাব্যথা
- চোখের জল পড়া
- ফোলা টনসিল
- গালের ভিতরে ছোট ছোট ফুসকুড়ি ইত্যাদি
শেষকথা
মনে রাখবেন, শিশুদের হাম থেকে রক্ষা করার জন্য টিকাদানের মাধ্যমে প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল। উপরোক্ত আলোচনায় আমি চেষ্টা করেছি, শিশুদের হাম কেন হয়, এর লক্ষণ,ভয়াবহতা এবং নবজাতক শিশুদের হাম হলে করনীয় সহ সকল বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা দেওয়ার। আমি আশা করি, আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লাগবে এবং হাম সম্পর্কে অনেক তথ্য পাবেন। ধন্যবাদ